সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইউরোপে যেভাবে নির্মূল করা হয়েছিল গুটি বসন্তের প্রাদুর্ভাব

ইউরোপে সর্বশেষ গুটি বসন্তের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল ১৯৭২ সালে তৎকালীন  হুগোস্লাভিয়ায়। দেশটি তখন খুবই সফলভাবে এর মোকাবেলা করেছিল ব্যাপক  গণ-টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে। ভাইরোলজিস্ট আনা গ্লিগিচ এই প্রাদুর্ভাব  মোকাবেলায় সাহায্য করেছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে ইতিহাসের সাক্ষীর এই  পর্বটি তৈরি করেছেন বিবিসির পেট্রা যিভিচ।

গুটি বসন্ত এক সংক্রামক অসুখ, এটি ছড়ায় ভ্যারিওলা নামের এক ভাইরাসের  মাধ্যমে। ১৯৮০ সালে গুটি বসন্ত নির্মূলের আগের শতকগুলোতে এই রোগে বিশ্বে  লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে।

গুটি বসন্তের লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, গলা-ব্যথা, শ্বাসযন্ত্রের  উপরের অংশে প্রদাহ। আক্রান্ত মানুষের কাশি বা হাঁচি থেকে বা তাদের গায়ের  চামড়ার ঘায়ের সরাসরি সংস্পর্শ থেকে এটি ছড়ায়।

গুটি বসন্ত ছিল বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম পুরোপুরি নির্মূল হওয়া কোন  সংক্রামক রোগ। এই সাফল্য ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে এক  ঐতিহাসিক ঘটনা।

কিন্তু পুরোপুরি নির্মূল হওয়ার আগে এটি ১৯৭২ সালের বসন্তকালে শেষ বারের  মতো ইউরোপে ধাক্কা দিয়েছিল। আনা গ্লিগিচ ছিলেন সাবেক হুগোস্লাভিয়ার  রাজধানী বেলগ্রেডের সেই ল্যাবরেটরির প্রধান, যেখানে সেই ১৮৮১ সাল হতে এই  রোগের টিকা দেয়া হচ্ছিল। ১৯৭২ সালের মার্চের এক সন্ধ্যায় যখন এক ব্যক্তি  এসে তাঁর দরোজার কড়া নাড়লেন, ডা. আনা বেশ অবাক হলেন।

তিনি বলেন, আমাদের ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক, যিনি একজন সংক্রামক ব্যাধি  বিশেষজ্ঞ, তিনি আমার দরজায় দাঁড়িয়ে। তিনি আমাকে বললেন, আপনাকে এখনই  আমাদের সঙ্গে আসতে হবে। আমরা সন্দেহ করছি, গুটি বসন্ত আবার ফিরে এসেছে। আমি  আমার স্বামীকে বললাম, এটা হয়তো গুটি বসন্ত নয়, আমরা হয়তো এবারও ভুল  করছি। ১৯৭২ সালের আগেও আমরা চারবার গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়ছে বলে  ভেবেছিলাম, কিন্তু প্রতিবারই তা ভুল প্রমাণ হয়েছে।

হুগোস্লাভিয়ায় গুটি বসন্তের সর্বশেষ সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ১৯৩০ সালে।  কাজেই এত দশক পরে গুটি বসন্তের সংক্রমণ শনাক্ত করতে ডাক্তারদের সময়  লাগছিল।

যেভাবে ধরা পড়লো ডাক্তাররা যখন প্রথম কয়েকটি কেস দেখলেন, তারা সন্দেহ করলেন, এটি গুটি  বসন্ত হতে পারে। কিন্তু তারা আসলে নিশ্চিতভাবে তা বলতে পারছিলেন না। তারা  ভাবছিলেন, এ কথা বললে তারা হয়তো হাসির পাত্র হবেন। এই ডাক্তাররা এর আগে  কখনো কোনো ভ্যারিওলা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী দেখেননি।

ডা. আনা গ্লিগিচ যখন ল্যাবরেটরিতে এসে পৌঁছালেন, তখন তার পরীক্ষার জন্য নমুনা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করে এবং অন্যান্য  পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এটি শনাক্ত করতে পারলাম।  আটটি নমুনার আটটিতেই ছিল গুটি বসন্তের ভাইরাস। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, এখন এক  ব্যাপক মহামারির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। কারণ যদি এরই মধ্যে ৮ জনের দেহে  এই ভাইরাস ছড়িয়ে গিয়ে থাকে, তারা আরও বহু মানুষের মধ্যে এই ভাইরাস  ছড়িয়ে দিয়েছে।

এর পরের কয়েকদিন ডা. আনাকে বেলগ্রেডের ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে  কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছিল। সেখানেই তাঁর জন্য খাবার নিয়ে আসা হতো।  তাঁকে একরাত কাটাতে হয়েছিল ল্যাবরেটরিতে নার্সদের ইউনিফর্মের এক স্তূপের  ওপর। তখনো তাঁরা আরও নমুনা আসার অপেক্ষায় আছেন।

তখনো পর্যন্ত কেউ জানেন না, কীভাবে এই ভাইরাস হুগোস্লাভিয়ায় ঢুকেছে।  ডা. আনা এবং কর্তৃপক্ষ তখনো পর্যন্ত কেবল এটুকুই জানেন যে, এই আটটি পজিটিভ  কেসের সবগুলোই ধরা পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলীয় কসোভোতে।

তিনি বলেন, আমরা যখন কসোভো থেকে আনা নমুনা পরীক্ষা করছিলাম, তখনো আমরা  জানি না যে, বেলগ্রেডের তিনটি হাসপাতালেও গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

স্বল্প সময়ের মধ্যে ডা. আনা এবং তার সহকর্মীদের ডাক পড়লো বেলগ্রেডের  হাসপাতালগুলোতে। কারণ কর্তৃপক্ষ তখন সন্দেহ করছে, হাসপাতালের কর্মীদের  মধ্যেও গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালের এক নারী নার্সকে তিনি  পরীক্ষা করলেন। তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, এই নারী গুটি বসন্তে  আক্রান্ত হননি। কিন্তু তারপরই তিনি শুনলেন, কেউ একজন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমি কোয়ারেন্টিন বক্সে ঢুকে দেখি ২০ এর কাছাকাছি বয়সের এক  সুন্দরী নারী। তার পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। মেয়েটি যে সবচেয়ে খারাপ ধরনের  গুটি বসন্তে আক্রান্ত, এটা ছিল তার প্রথম লক্ষণ। খুবই মারাত্মক ধরণের গুটি  বসন্ত। তার মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল।

সফল টিকাদান অভিযানগুটি বসন্তের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত করার পর কিন্তু ডা. আনার কাজ শেষ হয়ে গেল  না। তাকে এরপর আবার ল্যাবরেটরিতে ফিরে যেতে হলো, সেখানে তাকে নমুনা  পরীক্ষার কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছিল।

তিনি বলেন, আমার কাজ হয়ে দাঁড়ালো গুটি বসন্তের রোগীদের শনাক্ত করা।  কারও গুটি বসন্ত ধরা পড়ার পর সেই লোক যত লোকের সংস্পর্শে এসেছিল, তাদের  খুঁজে বের করা হচ্ছিল। তারপর লোকটির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ধরে এনে রাষ্ট্রীয়  ব্যবস্থায় কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছিল, তারা এটা পছন্দ করুক আর না করুক।

যদিও হুগোস্লাভিয়ার অল্প কিছু এলাকাতেই কেবল গুটি বসন্ত ধরা পড়েছিল,  তার পরও সরকার পুরো দেশের সব মানুষকে টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

লোকজনও টিকা নিতে চাইছিল। কাজেই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ১ কোটি ৮০ লাখ  মানুষকে গুটি বসন্তের টিকা দেয়া সম্ভব হলো। রেডিও-টেলিভিশনে এই টিকাদান  কার্যক্রমের ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল। লোকজনও ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারছিল। তারা  স্বাস্থ্য-কর্মীদের বিশ্বাস করছিল।

ডা. আনার আরেকটি দায়িত্ব ছিল টিকা পরীক্ষা করে দেখা। তিনি বলেন, দেশের  বাইরে থেকে মানবিক ত্রাণ সাহায্য হিসেবেও টিকা আসছিল। আমার দায়িত্ব ছিল,  এসব টিকা ব্যবহারের আগে, সেগুলোর তদারকি করা।

১৯৭২ সালের এপ্রিলের শেষ দিনটিতে ডা. আনার ওপরই দায়িত্ব পড়লো টেলিভিশন  ক্যামেরা সামনে দাঁড়িয়ে একথা ঘোষণা করা যে, অবশেষে হুগোস্লাভিয়ায় গুটি  বসন্তের মহামারি শেষ হয়েছে।

তিনি বলেছেন, আমার ইন্সটিটিউট থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছিল এই খবরটি দেয়ার জন্য, গুটি বসন্তের মহামারি শেষ হয়েছে।

এই মহামারিতে হুগোস্লাভিয়ায় ৩৫ জন মারা যায়, ১৭৫ জন মানুষ এতে ভুগেছিল।

এরপর হুগোস্লাভিয়ায় আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসলো। হুগোস্লাভিয়া  যেরকম দ্রুত এই গুটি বসন্তের প্রাদুর্ভাবের মোকাবেলা করেছিল, তার প্রশংসা  করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

তিনি বলেন, এটার দারুণ ফল হয়েছিল। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর  এটাই ছিল কোনো সংক্রামক রোগের সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব। আমি কিন্তু তখন  মোটেই ভয় পাইনি। তখন আমি মাত্রই বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক ভাইরাস মারবার্গ  নিয়ে গবেষণা শেষ করেছি। কাজেই গুটি বসন্তের ভাইরাস শনাক্ত করার জন্য আমি  কিন্তু বেশ দ্রুতই প্রস্তুত ছিলাম।  

সূত্র: বিবিসি।


মন্তব্যসমূহ

Popular post

নিকোলা টেসলাঃ ভুল সময়ে জন্ম নেয়া কিংবদন্তী।

  নিকোলা টেসলাঃ ভুল সময়ে জন্ম নেয়া কিংবদন্তী।  টেসলার জন্মকাহিনীঃ    কথিত আছে, টেসলার জন্ম হয় প্রচণ্ড ঝড় ও বজ্রপাতের রাতে। এরকম ঘটনাকে অশুভ সংকেত মনে করে সেই সময়ে ধাত্রী টেসলাকে ‘অন্ধকারের সন্তান’ (Child Of Darkness) বলেন। কিন্তু এতে টেসলার মা অপমানিত বোধ করে এর বিরোধিতা করে বলেন, টেসলা হবে ‘আলোর সন্তান’ (Child of Light); টেসলার মায়ের সেই ভবিষ্যৎ বানী যে কতটা কার্যকর ছিল তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না !  টেসলার দূরদৃষ্টি এবং বেতার ইন্টারনেট : টেসলা তার সব চমৎকার উদ্ভাবনী চিন্তা বাস্তবে রূপান্তর করে যেতে পারেননি। তিনি ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন নিয়ে বহু গবেষণা করেন। সেই ১৯০১ সালেই তিনি এসবের কথা চিন্তা করেন যার সুফল আমরা এখন ভোগ করছি। তিনি রেডিও জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে ‘ডেথ-রে’ (death-ray) নামক একটা কণার কথা চিন্তা করেন যার বাস্তব কোন রূপ তিনি দিয়ে যেতে পারেননি। টেসলার জাদুকরী স্মরণশক্তি : বিজ্ঞানী টেসলার স্মরণশক্তি এতটাই তীক্ষ্ণ ছিল যে তিনি একটা বই পড়লে তার প্রতিটি লাইন ও ছবি সহ বিশদভাবে মনে করতে পারতেন । তার প্রখর কল্পনা শক্তির কারণে ছোটবেলায় প্রায়ই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখতেন। প